চুকে গিয়েছে জমিদারী পাট, আছে বলির প্রচলন ১৮৬ বছর ধরে একচালায় দুর্গাপুজো হয়ে আসছে জেলার এই স্কুলে

কালের নিয়মে দুটি মন্দির ভগ্নপ্রায়। যদিও দুর্গা মন্দিরকে সারানোর ব্যবস্থা হলেও তা পর্যাপ্ত অর্থের অভাব রয়েছে। পুরনো প্রথা মেনেই আজও একচালা দুর্গা মূর্তি তৈরি করা হয়।

চুকে গিয়েছে জমিদারী পাট,  আছে বলির প্রচলন ১৮৬ বছর ধরে একচালায় দুর্গাপুজো হয়ে আসছে জেলার এই স্কুলে

ট্রাইব টিভি ডিজিটাল: জমিদারী নেই, তবুও দুর্গাপুজো হয়ে আসছে বৈঁচিগ্রাম BL স্কুলে। হুগলির পান্ডুয়ার বৈঁচিগ্রাম BL স্কুলে আনুমানিক ১৮৬ বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে। জমিদার বিহারী লাল মুখোপাধ্যায়ের বাবা ঠাকুর দাস মুখোপাধ্যায় এই পুজোর সূচনা করেছিলেন। সেই থেকেই আজও নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজো হয়ে আসছে।

জমিদারিত্ব নেই ও দেবত্ব সমত্তির অধিগ্রহনের ফলে ম্লান হয়েছে পুজো। সেই আমলে জমিদার বাড়ির গায়ে বড় বড় খিলান যুক্ত নাট মন্দির তৈরি করা হয়। সেখানেই মা দুর্গা ও জগদ্ধাত্রীর পুজো হয়। সেই সঙ্গে জমিদার বাড়ি ঢোকার আগেই একটি রাস মন্দির আছে। তাতে আজও টেরাকোটার নকশা খোদাই করা আছে।

তবে কালের নিয়মে দুটি মন্দির ভগ্নপ্রায়। যদিও দুর্গা মন্দিরকে সারানোর ব্যবস্থা হলেও তা পর্যাপ্ত অর্থের অভাব রয়েছে। পুরনো প্রথা মেনেই আজও একচালা দুর্গা মূর্তি তৈরি করা হয়। সিংহ বাহিনী মা দুর্গার সঙ্গে লক্ষী গণেশ সরস্বতী কার্তিক ও মহিষাসুর রয়েছে একচালাতেই। টানা চোখের বাংলা মুখের আদলে এই মূর্তি হয়। মহিষাসুরের গায়ের রঙ এখানে সবুজ রঙের হয়ে থাকে। স্কুলেই চলে ঠাকুর তৈরি করা, পরে মূল বেদীতে বসানো হয় দেবীকে।

ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত বৈদিক মতে মা দুর্গার পুজো হয়। আগে বলি প্রথা থাকলেও কালের নিয়মে তা বদলে গিয়ে এখন ঝাঁচি কুমড়ো কলা বলি হয়। দশমীর দিন আগে কাঁধে করে চার পাড়া ঘুরিয়ে প্রতিমাকে নিরঞ্জন করা হতো স্কুলেরই একটি পুকুরে। লোকের অভাবে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন ট্রাক্টারে করে চার পাড়া ঘুরিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। 

বিহারীলাল মুখোপাধ্যায় সহ তিন ভাই বৈঁচিগ্রামে জমিদারি স্থাপন করেছিলেন। জমিদারীর প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় বিহারীলালের আমলেই। বিহারীলাল ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর অবর্তমানে বিপুল সম্পত্তি কি হবে সেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন বিহারীলাল মুখোপাধ্যায় ও তার স্ত্রী কমলা কামিনী দেবী। এক সময় বিহারীলাল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পুত্র দত্তক নেওয়ার কথা প্রকাশ করেন। সেই সময় বিদ্যাসাগর মশাই পরামর্শ দেন এই বিপুল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সমাজ সেবামূলক কাজে ব্যবহার করতে। সে কথা চিন্তা করেই জমিদার বাড়িকেই বিদ্যালয় ও একটি দাতব্য চিকিৎসালয় করে যান বিহারীলাল। ১৮৭৭ সালে বিহারীলাল উচ্চ অবৈতনিক বিদ্যালয় ও একটি দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি করেন বৈঁচি গ্রামে বিদ্যাসাগরের পরামর্শ। সেই থেকেই স্কুলের জমিদার বাড়িতেই আজও পুজো হয়ে আসছে। 

পুজোর দিনগুলিতে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী এলাকার মানুষ ও শিক্ষকরা সবাই আসেন। জানা যায়, বিহারীলাল মুখোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়। তার প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয়বার তিনি বিবাহ করেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর নাম ছিল রাখালদাস মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর দুই পুত্র ছিলেন বিহারীলাল মুখোপাধ্যায় ও রামলাল মুখোপাধ্যায়। ১৮৭০ সালে বিহারী বাবু দলিল করেন সেখানে তিনি লেখেন আমি  নিঃসন্তান, আমার যা সম্পত্তি ও পুজোর সমস্ত কিছুই এই থেকে চলবে। সেইমতো সবই ঠিকঠাক চলছিল। ১৯৯৫ সালের পর থেকে সেগুলি বন্ধ হয়ে যায়। তবে কালের নিয়মে ঠাকুর দালান বাড়ি ভগ্নপ্রায় দশায় পরিণত হয়েছে। অর্থ সংগ্রহ করে সেগুলি সংস্কারের চেষ্টা করছে। 

সরকার থেকে যৎ সামান্য অনুদান দেওয়া হতো দুর্গাপুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য। যে টাকা অনুদান পাওয়া যেত সেই টাকায় পুজো চলত না। সে কারণেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ডিএম এর কাছেও সাহায্যের জন্য আবেদন করেছেন বলে জানান স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়। 

স্কুলের পূজারী সন্দীপ কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ''দুর্গাপূজো, দোল ও জগদ্ধাত্রী পুজোয় প্রচুর লোকের সমাগম হতো স্কুল চত্বরে। তবে কালের নিয়মে তা বদলে গেছে। নবমীর দিন গ্রামের প্রচুর মানুষ অঞ্জলি দিতে আসতো। এখন বিভিন্ন জায়গায় বারোয়ারি দুর্গা পুজো হওয়ায় তা ভাগ হয়ে গিয়েছে। আগে স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ড থেকেই এই পুজো চলত। তবে এখন আর সেভাবে অনুদান আসে না। তবে আজও নিষ্ঠার সঙ্গেই পুজো চলে আসছে।আগে গ্রামের প্রচুর মানুষকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হতো।''

স্কুলের এক ছাত্রী সঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ''সরস্বতী পুজো সব স্কুলে হয় তবে দুর্গাপুজো কোনও স্কুলে হয়, এমনটা আগে জানতাম না। পুজোর দিনগুলো স্কুলে এসে প্রতিমা দর্শন থেকে গল্প সবই চলে।'' গ্রামবাসী তথা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ''ভারতবর্ষের কোনও স্কুলে দুর্গাপুজো তা আমার জানা নেই। তবে বিএল স্কুলে দুর্গা পুজো হয়। ছোটবেলা থেকেই এই পুজো দেখে আসছি। তবে আগে যে পুজোর ঐতিহ্য ছিল তা এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে। শুধু তাই নয় দুর্গা মন্দিরের দালান বাড়িতেও ভগ্নপ্রায় দশায় পরিণত হয়েছে। মুখোপাধ্যায় তার সমস্ত সম্পত্তি সরকারকে দান করে গেছেন। যদি সরকার একটু দৃষ্টি দেয় তাহলে ভালো হয়।''