বুলেটে হৃদয় হয়েছে এফোঁড়-ওফোঁড়, মাতঙ্গিনী হাজরা তখনও ধরেছিলেন পতাকা

স্বাধীনতার জন্য এই যুদ্ধে পুরুষদের পাশে সমানভাবে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলার বীরাঙ্গনা নারীরাও। তারই মধ্যে এক উজ্জ্বল নাম মাতঙ্গিনী হাজরা।

বুলেটে হৃদয় হয়েছে এফোঁড়-ওফোঁড়, মাতঙ্গিনী হাজরা তখনও ধরেছিলেন পতাকা

ট্রাইব টিভি ডিজিটাল: রাত পোহালেই ১৫ অগাস্ট। দেশ জুড়ে পালিত হবে স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ। এই স্বাধীনতা লাভের দিনে ভারতের জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলনের সময় "মুক্তির মন্দির সোপনাতলে কত প্রাণ হল বলিদান লেখা আছে অশ্রু জলে"। এই গানটি যখন বেজে ওঠে, ভেসে ওঠে বহু শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।

 স্বাধীনতার জন্য এই যুদ্ধে পুরুষদের পাশে সমানভাবে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলার বীরাঙ্গনা নারীরাও। তারই মধ্যে এক উজ্জ্বল নাম মাতঙ্গিনী হাজরা। তখনকার অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার তমলুকের হোগলা গ্রামে ১৮৭০ সালে ১৯ অক্টোবর মাতঙ্গিনী হাজরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মেদিনীপুরের তমলুক থেকে অদূরের এই হোগলা নামে ছোট গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। বাবা- ঠাকুরদাস মাইতি ও মাতা-রজনী মাইতি (ভগবতী দেবী)-র ছোট মেয়ে মাতঙ্গিনী হাজরা। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই, মাত্র ১১ বছর বয়সে, রূপনারায়ণ নদে মিলিত হওয়া সোয়াদিঘী খালের অদূরে অবস্থিত আলীলান গ্রামের ষাট বছর বয়সী বিপত্নীক ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে বিবাহ হয় মাতঙ্গিনীর। কিন্তু বিয়ের মাত্র ছয় বছর পরে নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হয়েছিলেন তিনি ।

 স্বামীহারা নিঃসন্তান মাতঙ্গিনী দেশমাতৃকার জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করতে থাকেন অন্তরে। আর তাই তিনি প্রতিদিনই চলে আসতেন সিউড়ি গ্রামের প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী গুণধর ভৌমিকের বাড়িতে। গুণধর ভৌমিক ও তাঁর স্ত্রী, দুজনেই ছিলেন স্বাধীনতার যোদ্ধা। ১৯৩২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আয়োজন করে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করলেন ৬০ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী। শপথ নিলেন দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার।

এরপর ১৯০৫ সালে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন । মাতঙ্গিনী হাজরা মতাদর্শগত ভাবে তিনি ছিলেন একজন গান্ধীবাদী । তাইতো গান্ধী বুড়ি নামে ডাকা হয় তাঁকে । ১৯৩২ সালে মাতঙ্গিনী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে গ্রেফতার বরণ করেছিলেন । ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময় কংগ্রেস সদস্যরা মেদিনীপুর জেলার সকল থানা ও অন্যান্য সরকারি কার্যালয় দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে এখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা । তাই প্রথম মহিলা স্বেচ্ছাসেবক ছয় হাজার সমর্থক তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে একটি মিছিল বের করেন । এই মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা । মিছিলে বারংবার তাঁর গায়ে গুলি লাগে , তাঁর কপালে ও দুই হাতে । তবুও তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন । এরপর তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। 

কংগ্রেসের পতাকা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন । পরে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে অসংখ্য স্কুল , পাড়া ও রাস্তার নাম মাতঙ্গিনী হাজরার নামে উৎসর্গ করা হয় । স্বাধীন ভারতে কলকাতা শহরে প্রথম যে নারী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল , সেটি হলো মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি । ২০০২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের ডাক বিভাগ মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি দেওয়া ৫ টাকার পোস্টাল চালু করেন। 

এত স্মৃতি বিজড়িত সেই আলীলান গ্রাম এরকম সংগ্রামী মাতঙ্গিনীর মতন মেয়েকে পেয়ে গর্বিত আজও। আলীলান ও হোগলা গ্রামবাসীর পাশাপাশি তাঁর পরিবারের বর্তমান সদস্যরা জানান মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন একজন সংগ্রামী মহিলা তিনি বিবাহের পর এই আলীলান গ্রামে এসে মাত্র ৬ বছর সংসার জীবন কাটিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যা পদ গ্রহণ করেন এরপর তিনি ৭৩ বছর বৃদ্ধা অবস্থায় তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের চক্রান্তকে রুখে দিতে গিয়ে তাঁর ওপর গুলি বর্ষণ করা হয় এর ফলে তিনি সেখানেই শহীদ হন। যা আমাদের পরিবারের বর্তমান সদস্য সহ সমস্ত এলাকাবাসীর কাছে স্মরণীয় ইতিহাস।

আর এই সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আরও বেশি করে স্মরণ করে রাখতে বর্তমান তমলুকের বিধায়ক ড. সৌমেন কুমার মহাপাত্রের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আলীলান গ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার মিউজিয়াম ঘর, এই ঘরে স্বাধীনতা সংগ্রামী মাতঙ্গিনী হাজরার সমস্ত রকম নথি সহ তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্র রাখা হবে বলে জানা যায়। আর সেই মতো অবস্থায় চলছে জোর কদমে কাজ। এবং এই কাজ আর কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হবে এমনটাই জানা যায়। তবে কাজ শেষ হলেই ওই সমস্ত মিউজিয়াম দেখতে ভিড় জমাবেন বহু মানুষজন এমনটাই আশা করছেন আলীলানবাসি।তবে কবে আসবে সেই সুদিন সেইদিকে তাকিয়ে আছে আপামোর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মানুষ।